ভ্যানকুভার, এই শহরটির নাম প্রথমে শুনেছিলাম ২০০৯ সালে। তখন আমার এ সম্পর্কে এতটা ধারণা ছিল না। ২০১০ সালে শীতকালীন অলিম্পিক গেমস চলাকালে এই শহরটির নাম প্রথম শুনেছিলাম। তখনও ভাবতে পারিনি যে, এর ১০ বছর পরে এই শহরে আমার বর্তমান আবাস্থল হবে। শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের সময়ে দেখেছিলাম যে, সবকিছু বরফে ঢাকা এবং সবাই স্কিয়িং ও বিভিন্ন আইস গেমস খেলতে ব্যস্ত। তখন মনে হয়েছিল যে, এখানে মনে হয় সারা বছরই ঠান্ডা থাকে। কিন্তু কানাডাতে আসার পর জানতে পারি যে, এই শহরের আবহাওয়া কানাডার অন্যান্য শহরগুলোর চেয়ে উষ্ণতর এবং সহনীয় আবহাওয়া এখানে সবসময় বিরাজমান। পাশপাশি, এই শহরটি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বসবাসযোগ্য শহরগুলোর মধ্যে একটি।
এখন আসা যাক এই শহরের কিছুটা বিস্তারিত বিবরণ সম্পর্কে। ভ্যানকুভার হল কানাডার তৃতীয় এবং ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের সর্ববৃহৎ শহর। এই শহরটি কানাডার অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্রও বটে। সাবেক ব্রিটিশ নেভি অফিসার জর্জ ভ্যানকুভারের নামে এই শহরের নামকরণ করা হয়। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হলেও, এটি এখানকার রাজধানী শহর নয়। এর রাজধানী হল ভিক্টোরিয়া যেখানে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার সরকারি কেন্দ্রীয় অফিস আদালতের অবস্থান। ভ্যানকুভার শহর আসলে বড় দেখতে মনে হলেও তা প্রকৃতপক্ষে এতটা বড় নয়। মূল ভ্যানকুভার শহরের আয়তন কিন্তু এতটা বড় নয়। আশেপাশের ছোট ছোট শহর যেমন বার্নাবি, সারে, রিচমন্ড, নিউ ওয়েষ্টমিনিস্টার এবং নর্থ ভ্যানকুভারকে সাথে নিয়েই মেট্রো ভ্যানকুভার গঠিত। মূল ভ্যানকুভারের আয়তন আমাদের ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেক। ভৌগলিকভাবে, পুরো শহরটি সাগর এবং পাহাড়-পর্বত দ্বারা আবৃত। বিশেষ করে উত্তর ভ্যানকুভার শহরটির পুরোটাই একটি পাহাড়ি অঞ্চল। তাই দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মত এখানেও সাগর এবং পাহাড়ের সমন্বয় চোখে লাগার মত। বিস্তারিতভাবে বললে, পুরো ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশই প্যাসিফিক সাগরের ধারে অবস্থিত। যার জন্যে এখানকার অঞ্চলগুলো কানাডার অন্যান্য প্রদেশের অঞ্চলগুলো থেকে উষ্ণতর। ভ্যানকুভারের আবহাওয়া গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ ৩২ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে যায় এবং শীতকালে সর্বনিম্ন -১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়। শীতকালে এখানে তুষারপাত কম হয় এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেকটা বেশি হয়। এখানে প্রায় একটানা এক মাস বিরতিহীন বৃষ্টিপাতের রেকর্ড আছে। এরকম যদি আমাদের দেশে হত তবে, পুরো দেশ পানির তলে ডুবে যেত। মেট্রো ভ্যানকুভারের জনসংখ্যা প্রায় ২৪ লাখের মতন। এ শহরকে আপনি একটি বহুজাতিক শহরও বলতে পারেন। এখানে নানান দেশ থেকে আগত লোকজন একসঙ্গে বসবাস করছেন। তবে সংখ্যার দিক থেকে চাইনিজ এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ান লোকজনদের সংখ্যাই বেশি। পাশাপাশি বেশিরভাগ ব্যবসা বাণিজ্য তাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। তাই শহরের কোন ব্যাস্ত রাস্তায় হাঁটলে মনে হতে পারে যে, আপনি কানাডাতে নয় চীনের সাংহাই বা গুয়াংজু শহরে আগমন করেছেন। এই শহরের যাতায়াত ব্যবস্থাও খুবই উন্নত। আপনি ট্রানজিট বাসে করে বা স্কাইট্রেনে (মেট্রোট্রেন)করে শহরের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সহজে যাতায়াত করতে পারেন। শহরের প্রত্যেকটি এলাকায় কমিউনিটি পার্ক রয়েছে। এবং এখানে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্রের অভাব নেই। গ্রীষ্মকালে এখানে দেশী-বিদেশী প্রচুর পর্যটকের সমাগন হয়। তাই এই প্রবন্ধের আয়োজন ভ্যানকুভার শহরের উল্লেখযোগ্য পর্যটনকেন্দ্রগুলোকে নিয়ে। যেহেতু এই শহরে অনেকগুলো পর্যটন আকর্ষণ রয়েছে তাই উক্ত প্রবন্ধে সব কিছুর বর্ণনা করলে তা অনেক লম্বা এক প্রবন্ধ হবে। তাই ভ্যানকুভার শহরকে নিয়ে এই প্রবন্ধের এই পর্বে আপনাদের জানাবো এই শহরের আকর্ষণীয় পার্কগুলোর সম্পর্কে।
স্ট্যানলি পার্ক
এই শহরের মূল আকর্ষণ বলা হয় এই পার্কটিকে। এই পার্কটি উত্তর আমেরিকার সর্ববৃহৎ সিটি পার্ক হিসেবে পরিচিত। মোট ১০০০ একরের এই বিশাল পার্কটি দূর থেকে দেখলে মনে হবে একটি দ্বীপের মত। এই জায়গাটি পূর্বে সাবেক ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড আর্থার স্ট্যানলির ব্যাক্তিগত জায়গা ছিল। কিন্তু তার মৃত্যুর আগে তিনি তার সম্পূর্ণ জায়গাটি সিটি কাউন্সিলকে দান করে যান এবং তিনি শর্ত দেন যে, এখানে জনসাধারণদের জন্য একটি পার্ক নির্মাণ হবে যেখানে সবাই বিনামূল্যে ঘুরাফেরা করতে পারবে। সিটি কাউন্সিল তার আদেশ পালন করে এবং তার নামে এই পার্কের নামকরণ করা হয়। বিশাল এই পার্কের সবটুকুতে হেঁটে বেড়াতে হলে আপনাকে সম্পূর্ণ দিন পার করতে হবে। এখানে উল্লেখযোগ্য দুটি লেক রয়েছে যার একটির নাম লস্ট লাগুন এবং অন্যটি বিভার লেক নামে পরিচিত। বিভার লেকে অনেক ফুটন্ত পদ্মফুলের দেখা মেলে। এছাড়াও পার্কের উত্তর পাশে রয়েছে একটি সুদীর্ঘ কোরাল বিচ। কয়েকটি পাহাড়ি ট্রেইলও রয়েছে যেখানে ট্র্যাকিং করা যায়। আর এর বাকি সবটুকু সবুজ চাদরে মোড়ানো। তাছাড়া এখানে বিভিন্ন রকমের গাছপালা রয়েছে। সাইক্লিষ্টদের জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান এবং পুরো পার্কে সাইক্লিং এর জন্যে আলাদা একটি রাস্তা রয়েছে। ব্যাক্তিগত গাড়ি নিয়ে ঘুরবার জন্যে রাস্তায় আলাদা একটি লেন আছে। যদি আপনার ব্যাক্তিগত গাড়ি বা সাইকেল না থাকে তারপরেও চিন্তার কিছু নেই। আপনি চাইলে পার্কের ভিতর ঘোড়ার গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াতে পারেন। এজন্য আপনাকে পয়সা খরচ করতে হবে। বাহির থেকে আগত বেশিরভাগ টুরিস্টরাই এই ঘোড়ার গাড়িতে চরে পুরো পার্কে ঘুরে বেড়ান। ঘোড়ার গাড়ির এই রাইডে সম্পূর্ণ পার্ক ঘুরে দেখানো হয় এবং পার্কের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য স্থানে থামানো হয়। একজন টুরিস্ট গাইড এই সম্পূর্ণ রাইডটি পরিচালনা করেন এবং বিভিন্ন স্থানের ধারাবিবরণী দেন। তবে পার্কের সবচাইতে সুন্দর স্থান হল উত্তর পার্শে অবস্থিত এই কোরাল বিচটি। এই বিচে অনেক কোরাল পাথর সারি সারি অবস্থানে রয়েছে। এই বিচে কানাডিয়ান হাঁসেরা দলে দলে বিচরণ করে বেড়ায়। এই বিচ থেকে সাগরের ওপারে অবস্থিত উত্তর ভ্যানকুভার শহরের প্যানরামিক ভিউ দেখতে পাওয়া যায়। দূর থেকে শহরের প্রধান ঝুলন্ত সেতু লায়ন্স গেট ব্রিজকেও দেখতে দারুন মনে হয়। এই ব্রিজটি উত্তর এবং দক্ষিন ভ্যানকুভার ( ডাউনটাউন ভ্যানকুভার) শহরকে সংযুক্ত করেছে। বিচের ধারে উঁচু স্থানে বাধের মত রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে এখানে এবং রাস্তার ধারে বসবার জন্য অনেকগুলো বেঞ্চ রয়েছে। সেখানে বসে চাইলে কিছুটা শান্ত সময় পার করা যায়। শিশুদের জন্যে এখানে অনেকগুলো প্লে গ্রাউন্ড রয়েছে। সপ্তাহশেষে এখানে একটু বেশি ভিড় হয়। কিন্তু অন্যান্য দিনগুলোতে এখানকার পরিবেশ অনেক নিরব থাকে।


ওয়াটারফ্রন্ট পার্ক
উত্তর ভ্যানকুভারে অবস্থিত এই পার্কটি একেবারেই সাগরের কিনারায় ঘেঁষে রয়েছে। এই পার্কে কোন বিচ নেই, কিন্তু এর ওয়াকওয়ে একবারে সাগরের কিনারায় নির্মিত হয়েছে। তাই যদি আপনি এখানে বিকেল বেলায় হাঁটতে বের হন তবে হাঁটতে হাঁটতে সাগরের ঢেউ এর খেলা আপনার চোখে পড়বে সবসময়। তীব্র জোয়ারে পাথরের বাঁধে ধাক্কা খাওয়া সাগরের পানি ছিটে আপনি অনুভব করতে পারবেন এখানে। আপনি চাইলে হেঁটে হেঁটে চলে যেতে পারেন ডকইয়ার্ডের কাছে, যেখানে গেলে চোখে পড়বে প্রায় শতখানেক প্রমোদতরী। এখানকার বিত্তবানদের প্রমোদতরীগুলো এই ডকইয়ার্ডে বাঁধা থাকে। এই ডকইয়ার্ডে অনেকগুলো ভাসমান বাড়ি আপনার চোখে পড়বে। এই বাড়িগুলো হল বিত্তবানদের অবসর সময় কাটাবার স্থান। অনেকে আবার এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। এই পার্কে সাগরের ধারে বসে বিশ্রাম করবার জন্য অনেকগুলো বেঞ্চ রয়েছে। সেখানে বসে কিছুক্ষণ অলস সময় কাটালে মন্দ হবে না। তখন আপনার চোখে ভেসে আসবে দক্ষিণ পার্শে অবস্থিত ডাউনটাউন শহর এবং শহরের প্রধান সমুদ্র বন্দর ভ্যানকুভার হার্ভার। এই পার্কের অপর পাশে রয়েছে অনেকগুলো সবুজ মাঠ। পার্কের পূর্বপাশে রয়েছে লন্সডেল কুয়েই ফেরিঘাট যেখানে লোকজন উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে যাতায়াত করে থাকেন ফেরি পারাপারের মাধ্যমে। ফেরিঘাটের পাশেই অবস্থান করছে লন্সডেল কুয়েই মল। এখানে খাবার দোকানের সংখ্যাই বেশি এবং কিছু কিছু সুভেনিয়ার শপ রয়েছে। মলের বাহিরে কিছু রেস্টুরেন্ট ও বার রয়েছে যেগুলো একেবারেই সাগরের কিনারে অবস্থিত। এখান থেকে দুপুরে লাঞ্চ বা রাতে ডিনার সেরে নিলে মন্দ হবে না। এখান থেকে আরও পূর্ব পাশে অবস্থান করছে শিপিংইয়ার্ড যেখানে আগে বাণিজ্যিক জাহাজগুলো নোঙ্গর করতো। কিন্তু এখন সেই ঘাটগুলোতে দর্শনার্থীদের আনাগোনা থাকে। উক্ত এলাকায় গড়ে উঠেছে অনেকগুলো হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট। ঘাটগুলোতে মাঝে মাঝে কিছু জাহাজকে নোঙ্গর করতে দেখা যায়।
ক্যাপিলানো পার্ক
এটি উত্তর ভ্যানকুভারের একটি অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। আগেই উল্লেখ করেছিলাম যে, উত্তর ভ্যানকুভার শহরটির পুরোটাই একটি পাহাড়ি অঞ্চল। তাই পাহাড়ি অঞ্চলে এমন একটা পার্কের প্রতি সবারই আকর্ষণ থাকবে। তবে এই পার্কটি অন্যান্য পার্কগুলো থেকে একদমই আলাদা। পাহাড়ি পার্ক হওয়া সত্ত্বেও আপনাকে এখানে ট্রেইল বেয়ে কষ্ট করে পাহাড়ে উঠতে হবে না। কারণ এখানে গাছের উপর কাঠের সেতু বানিয়ে ট্রি ওয়াক ট্রেইল বানানো হয়েছে। তবে এই পার্কের মূল আকর্ষণ হল ১৪০ মিটার দৈর্ঘের একটি ঝুলন্ত ব্রিজ যার কারণে এই পার্কের অফিসিয়াল নাম ক্যাপিলানো সাস্পেনশন ব্রিজ পার্ক। এই ব্রিজের নিচে একটি নদী প্রবাহমান আছে যা ক্যাপিলানো রিভার নামে পরিচিত। এই নদী থেকে ব্রিজটি ৭০ মিটার উঁচুতে অবস্থান করছে। তাই এই ঝুলন্ত ব্রিজে উঠে নিচে তাকালে সবার মনেই কিছুক্ষণের জন্য কাঁপন ধরবে অবশ্যই। যাদের হাইটফোবিয়া আছে, তাদের এখানে না ওঠাই ভাল। কিন্তু এই ব্রিজ পার না হলে আপনি ওপারের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন না। কারণ, এই ঝুলন্ত সেতু দুটি পাহাড়কে একত্রিত করেছে। এই সেতু পার হবার পর আপনি ট্রি ওয়াক ট্রেইলের পথ ধরতে পারবেন। সেখানেও কাঠের তৈরি কিছু ঝুলন্ত সেতু রয়েছে। কিন্তু এগুলো এতটা বড় নয়, ছোট ছোট সেতু। ট্রি ওয়াক ট্রেইল শেষ হলেই পৌঁছে যাবেন জঙ্গল ট্রেইলে। জঙ্গল ট্রিলের পুরোটাই কাঠের তৈরি, অনেকটা কাঠের তৈরি সেতুর মতন যেমনটা আমরা আমাদের দেশের সুন্দরবনের করমজল ফরস্ট্রিতে দেখে থাকি। এই সম্পূর্ণ ট্রেইল শেষ করতে আপনার খুব বেশি সময় লাগবে না। ট্রেইল শেষ হলেই আবার সেই ঝুলন্ত ব্রিজে পার হয়ে যেতে পারেন ওপারে। যদি এই ঝুলন্ত সেতুটিকে আপনার ভয়ংকর মনে হয় তবে আপনি ভুল ভাবছেন। ওপারে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে আরও ভয়ংকর কিছু। এই ভয়ংকর আয়োজনের নাম হল “ক্লিফ ওয়াক ট্রেইল”। এখানে আপনাকে ভয়ংকর ট্রেইলটি পার করতে সাহসিকতার পরিচয় দিতে হবে। এখানে পাথরের পাহাড়ের কিনারায় তৈরি করা হয়েছে একটি ঝুলন্ত ট্রেইল তৈরি করা হয়েছে এবং ট্রেইল ব্রিজগুলোর নিচ লোহার তৈরি জাল দ্বারা নির্মিত। তাই নিচে তাকালেই আপনার মনে ভয়ের সৃষ্টি হবে, কারণ আপনি পাহাড়ের তলদেশ স্বচ্ছ চোখে দেখতে পাবেন। এটা অনেকটা মালয়েশিয়ার লাংকাউই এর স্কাইব্রিজের মত অনেকটা। এই ট্রেইল শেষ হলে আপনি পৌঁছে যাবেন একটি ছোটখাটো রেইন ফরেস্টে। এই রেইন ফরেস্টের যাত্রাটাও আপনার অনেক ভাল লাগবে এবং এই জঙ্গল পার হলেই এই পার্কে যাত্রার পরিসমাপ্তি ঘটবে। এই পার্কে একটি রেস্টুরেন্ট এবং একটি সুভেনিয়র শপ আছে। পার্কে প্রবেশ মুখে ঢুকতে এখানকার আদিবাসিদের ইতিহাস সম্পর্কেও জানতে পারবেন।

কুইন এলিজাবেথ পার্ক
কানাডা একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও, ব্রিটেনের রাণী কুইন এলিজাবেথকে এখানকার প্রধান শাসক বলে বিবেচনা করা হয়। তাই এই পার্কের নাম তার সম্মাননার জন্যই দেওয়া হয়েছে। ভ্যানকুভারের দক্ষিণপূর্ব দিকে অবস্থিত এই পার্কটি মূলত একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন বলা চলে। পাহাড়ের উপর গড়ে ওঠা এই পার্কটির আয়তন প্রায় ১৩০ একর এবং যে পাহাড়ের উপর গড়ে উঠেছে তার নাম হল লিটল মাউন্টেন। এই পার্ক সম্পূর্ণ প্রদক্ষিণ করতে হলে আপনাকে অনেক হাইকিং করতে হবে। তবে আপনার যদি একটি ব্যাক্তিগত গাড়ি সঙ্গে থাকে তবে আপনার কষ্ট অনেকখানি কমে যাবে। তবে পার্কের পুরো ভেতরে গিয়ে সবটুকু ঘুরে দেখতে চাইলে আপনাকে কিছুটা হাইকিং করতে হবেই। এখন আসা যাক পার্কের ভেতর কি আছে না আছে। একে যদি দেখে আপনারা একটি পাহাড়ি ফুলের বাগান বলেন তবে তা মন্দ হবে না। কারণ, পুরো পার্কটিতে প্রায় শতাধিক রকমের ফুলের গাছ আছে। ফুলের গাছ ছাড়াও এখানে অন্যপ্রকার বট-বৃক্ষের অভাব নেই। হাইকিং করতে করতে হাঁপিয়ে গেলে বসে যেতে পারেন কোন পার্ক বেঞ্চে, কারণ এখানে বেঞ্চের কোন অভাব নেই। অথবা গাছের ছায়ার নিচে বসে বিশ্রাম করতে পারেন। চাইলে এখানে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বনভোজনও করা যাবে। কারণ পার্কের বিভিন্ন স্থানে অনেকগুলো ওপেন স্পেস রয়েছে যা সবুজের চাদরে মোড়ানো। পাহাড়ি এই পার্কটির একদম ওপরে একটি গম্বুজ আকৃতির কাঁচের তৈরি ভবন দৃশ্যমান হবে। এটি মূলত একটি কন্সারভেটরি, যেখানে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষকূলকে এনে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এটা অনেকটা গ্রিন হাউজের মত, যাতে এখানকার তীব্র শীতকালীন আবহাওয়াতে গাছগুলো বেঁচে থাকতে পারে। এবং যেখানে এই কন্সারভেটরির অবস্থান তার অপর পাশ থেকে পুরো উত্তর ভ্যানকুভার শহর দৃশ্যমান। এছাড়া পাহাড়ি এই পার্কটির নিচে একটি রোজ গার্ডেন রয়েছে যেখানে, গ্রীষ্মকালে নানান রং এর গোলাগ ফুল ফুটন্ত অবস্থায় দেখতে পাবেন। ঠিক তার পাশেই রয়েছে একটি গলফ কোর্স, কয়েকটি পিকনিক স্পট এবং একটি বাচ্চাদের জন্য প্লে গ্রাউন্ড।

বার্নাবি লেক/ বার্নাবি রিজিয়নাল পার্ক
আগেই উল্লেখ করেছিলাম যে, ভ্যানকুভার শহর হল মূলত আশেপাশের ছোট ছোট শহর যেমন বার্নাবি, সারে, রিচমন্ড, নিউ ওয়েষ্টমিনিস্টার এবং নর্থ ভ্যানকুভারকে সাথে নিয়েই গঠিত। এবং বার্নাবি শহরটিও মূল ভ্যানকুভার শহরের সাথে সংযুক্ত। বার্নাবির মূল শহরতলী থেকে প্রায় একটু দূরে অবস্থিত এই বার্নাবি রিজিয়নাল পার্ক যা হিসেব করলে মূল ভ্যানকুভার শহর থেকে খুব একটা দূরে নয়। গাড়িতে বা বাসে মাত্র আধাঘন্টা সময় লাগে। প্রায় এক হাজার একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত এই পার্কের মূল আকর্ষণ হল বার্নাবি লেক এবং পার্কের ঠিক মাঝ বরাবর অবস্থিত এই লেকের আয়তন প্রায় ৭৭০ একর। এবং লেকের চারপাশ ঘন জঙ্গল দ্বারা আবৃত। এই জঙ্গলে হাইকিং এর জন্য আলাদা ট্রেইল রয়েছে যার সম্পূর্ণ শেষ করতে প্রায় ২ ঘন্টা সময় লাগবে। লেকের চারপাশের জঙ্গল এতটাই ঘন যে, জঙ্গল ট্রেইলের কিছু জায়গাতে ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকে। সেখানে সূর্যের আলো ঠিকমত পৌঁছাতে পারেনা বলে এমন অবস্থা হয়। এবং এই জঙ্গলে ভাল্লুকদের বিচরণ বিদ্যমান। তাই এখানে কিছুক্ষণ একা একা হাঁটলে আপনার মনের ভিতরে ভয়ের সৃষ্টি হতে পারে। তবে সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে অনেক লোকজন এখানে হাইকিং করতে আসেন। তাই আপনি চাইলে সেসময় তাদের সাথে যোগ দিতে পারেন, কারণ দলবদ্ধভাবে হাইকিং করলে আপনার মনে ভয় কাজ করবে না। জঙ্গলে থমথমে পরিবেশ থাকলেও লেকের পরিবেশ অনেক শান্ত। এই লেকের ধারে অনেকগুলো ওয়াচিং পয়েন্ট রয়েছে, এগুলো বলতে গেলে অনেকটা কাঠের ব্রিজের মত দেখতে। এখানে দাঁড়িয়ে লেকের শান্ত পরিবেশ উপভোগ করা যাবে। যদি আপনি জঙ্গলে হাইকিং করতে না চান তবে পার্কের গাড়ি পারকিং লটের ঠিক পাশেই একটা ওয়াচিং পয়েন্ট আছে। সেখানে থেকে চাইলে আপনি কায়াকিং এর জন্য নৌকাও ভাড়া করতে পারেন। এই লেকে অনেককেই কায়াকিং করতে দেখা যায়। কায়াকিং করেই অনেকে লেকের এপার থেকে ওপারে চলাচল করে থাকেন। এই লেকে মালর্ড প্রজাতির হাঁসদের অবাধ বিচরণ লক্ষ্য করতে পারবেন। এই রিজিয়নাল পার্কের পাশে একটি স্পোর্টস কমপ্লেক্স আছে এবং এর দক্ষিন পার্শে একটি হর্স ট্রেইলও রয়েছে।
রিচমন্ড গ্যারি পয়েন্ট পার্ক
এই পার্কটি আমার কাছে অনেকটা ঢাকা শহরের পূর্বাচলের ৩০০ ফিটের খোলা জায়গার মত মনে হয়েছে। তবে এখানকার প্রধান আকর্ষণ হল নদীর মোহনা। এখানে ফ্রেজার নদী গতিপথ শেষ হয়ে সাগরে মোহনায় মিশে গিয়েছে। এই পার্কটির অবস্থান ভ্যানকুভারের সাথে সংযুক্ত আরেক শহর রিচমন্ডে। এই পার্কটি বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বনভোজনের জন্য উপযুক্ত একটি পার্ক। এখানে ছুটির দিনে কিছুটা ভিড় লক্ষ্য করা যায়। অনেককেই দেখা যায় যে, নদীর ধারে খোলা স্থানে বারবি -কিউ পার্টি করতে। মাঝখানে একটা খোলা মাঠ আছে সেখানে অনেককেই দেখা যায় নানান রং এর রঙিন ঘুড়ি উড়াতে। নদীর কিনারে হওয়াতে এখানে বাতাসের বেগ স্বাভাবিক ভাবে একটু বেশি থাকে বলে, এখানে অনেকে ঘুড়ি উড়াতে আসেন। এখানে নদী ও সাগরের মোহনা একদম কাছ থেকে দেখবার জন্য একটি ওয়াচ পয়েন্ট আছে। এই পার্কের পাশেই রয়েছে একটি জেলেপল্লী যা স্টিভস্টন ফিশারম্যান ওয়ারফ নামে পরিচিত। এটি বলা চলে নদীর একটি ঘাট যেখানে অনেক জেলেনৌকা ঘাটে ভিড়ানো থাকে এবং সেখান থেকেই জেলেরা তাদের সংগ্রহকৃত মাছ লোকজনদের নিকট বিক্রয় করেন। এই ঘাট সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তবে মাছ কিনতে হলে আগেভাগে সেখানে উপস্থিত হওয়া ভাল। কেননা, এখানে একদম তাজা মাছ বিক্রয় হয় বলে খুব দ্রুতই সব মাছ বিক্রি হয়ে যায়। এই ঘাটের অপরদিকে অনেকগুলো সুভেনিয়র শপ এবং নানান ধরণের সীফুড রেস্টুরেন্ট আছে।
গ্র্যানভিল আইল্যান্ড
আপনাদের শুনে মনে হত পারে যে, এটি কোন একটি দ্বীপ হবে কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এটি কোন দ্বীপ নয়। এটি মূলত একটি সীফুড মার্কেট এরিয়া যা দেখতে কিছুটা দ্বীপের মত। ভ্যানকুভারের গ্র্যানভিল স্ট্রিট ব্রিজের নিচে এর অবস্থান এবং ব্রিটিশ ব্যবসায়ী গ্র্যানভিল লেভিসনের নামে এর নামকরণ করা হয়েছে। আমারও এর সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না এবং যাওয়ার কোন ইচ্ছাও ছিল না বটে। কিন্তু এর পাশে অবস্থিত ফলস ক্রিক পার্ক বরাবর হাঁটতে হাঁটতে আচমকা এখানে এসে পৌঁছে যাই। এখানে পৌঁছাবার পর জানতে পারলাম যে, এটি শুধু একটি সীফুড মার্কেট নয় বরং এই স্থানটি হল ভ্যানকুভার শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত শপিং ডিস্ট্রিক্ট। এখানকার মূল আকর্ষণ হল ১০০ বছরের পুরানো একটি মদের কারখানা যেটি এখনও পর্যন্ত চালু অবস্থায় আছে। এখানে অনেকগুলো মার্কেট রয়েছে যেখানে সীফুড থেকে শুরু করে চকলেট, কফি, বিভিন্ন রকমের তাজা ফলমূল এবং নানান প্রকার গ্রোসারি আইটেম পাওয়া যায়। এখানে প্রায় সবসময় মানুষজনের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। খাবারে মার্কেট ছাড়াও এখানে সুভেনিয়র শপ বা অন্যান্য দোকানপাটের অভাব নেই। প্রায় সব কিছুই এখান থেকে কেনা সম্ভব। এখানে বার, রেস্টুরেন্ট বা কফি শপেরও কোন অভাব নেই। এবং এগুলো অনেক বছরের পুরানো। এখানে কিছু চকলেট শপ দেখেছি যেগুলো শতাধিক বছরের পুরানো ছিল। সেখান থেকেই ধারণা করে বলছি যে এখানকার দোকানগুলো অনেক পুরাতন। স্থানীয় লোকজনের নিকট শুনেছিলাম যে এখানে আগে জেলেপল্লী ছিল। কিন্তু এখন এখানে একটি শপিং ডিস্ট্রিক্ট গড়ে তোলা হয়েছে। এখানকার রেস্টুরেন্টগুলোর ওপেন স্পেসে সবাইকে সময় কাটাতে দেখা যায়। অনেককে এখানে সংগীত পরিবেশন করতে দেখা যায়। পাশাপাশি এখানে সীগাল পাখি এবং কবুতরের আনাগোনা অনেক বেশি। সীগাল এবং কবুতরগুলোকে মানুষ সাধারণত খাবার ছিটিয়ে দিয়ে থাকেন। সেজন্যই এখানে তাদের আনাগোনা বেশি। এই পাখিগুলো মানুষদের মাঝে মাঝে উত্তক্ত করে থাকে। কিন্তু মানুষজন এগুলো উপভোগই করে। এই আইল্যান্ডের পাশে রয়েছে ফলসক্রিক পার্ক। এবং সাগর প্রনালীর অপর পাশে রয়েছে আরও অনেকগুলো পার্ক যেমন ক্রিকসাইড পার্ক এবং ডেভিড ল্যাম পার্ক। এই পার্কগুলোতে লোকজন মর্নিং ও ইভিনিং ওয়াক করতে আসেন।
আজকের আয়োজন এতটুকুই। এই ভ্যানকুভার শহর নিয়ে আরও কথা হবে পরবর্তী পর্বে। আজকাল অনেককেই দেখা যাচ্ছে সাবধানতা অবলম্বন করে ঘুরে বেড়াতে, তবে আপনি এটা করবার আগে ভালভাবে ভেবে নিন। যদিও বিশ্বের কিছু জায়গা এখন নিরাপদ, তবে কোন জায়গায় এখনও এই মহামারির প্রকোপ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। সবাই ভাল থাকবেন ও সুস্থ থাকবেন এবং নিজ নিজ অবস্থানে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখবেন।
ছবিসূত্র – নিজস্ব ধারণকৃত।