আমরা ভ্রমনপ্রিয় সকলে সবসময় এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে ভালবাসি। আমাদের এদিক ওদিক ছুটাছুটি যখন নিয়মিত করতে হয়, তখন আমাদের অনেক সময় নানাবিধ সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। সমস্যাগুলো আসলে খুবই ক্ষুদ্র কিন্তু ঠিক ঐ মুহূর্তে আমাদের নিকট তা অতি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে। এধরণের সমস্যায় পড়তে হয়, সাধারণত আমরা যখন বিদেশ ভ্রমণে বের হই। তাছাড়াও কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে যা আমাদের হাতে থাকলে আমাদের ভ্রমনযাত্রা আরও সহজ হয়। তাই আজকের বিষয় সেইসকল ১০ টি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সম্পর্কে।
পাওয়ার কিউব/ ইউনিভারস্যাল এডাপ্টার
বিদেশ গেলে সাধারণত আমরা প্রথমে যে সমস্যার সম্মুখীন হই তা হল আমাদের মোবাইল বা অন্যান্য ইলেকট্রিক ডিভাইসগুলো চার্জ করা নিয়ে। আমরা সাধারণত যে ধরণের চার্জার বা চার্জিং পয়েন্ট আমাদের দেশে ব্যবহার করে থাকি বিদেশে গেলে দেখা যায় যে, সেখানকার চার্জিং পয়েন্ট একেবারেই আলাদা এবং আমাদের সাধারণ চার্জার দিয়ে চার্জ করা একেবারেই অসম্ভব হয়ে যায়। এ ধরণের সমস্যা হয় সাধারণত ইউরোপ বা আমেরিকায় গেলে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও এ ধরণের সমস্যায় পড়তে হয়। যখন ইন্দোনেশিয়া ভ্রমনে যাই, তখন আমাকে এ ধরণের সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। এবং আমাদের দেশের মধ্যেও একেক জায়গায় একেক চার্জিং পয়েন্ট থাকে। এ ধরণের সমস্যার সমাধান একটাই, তা হল ইউনিভারস্যাল এডাপ্টার বা পাওয়ার কিউব সাথে রাখা। এ ধরণের পাওয়ার এডাপ্টারে বিভিন্ন ধরণের প্লাগিং পয়েন্ট থাকে এবং তা প্রায় সকল ধরেনর ইলেকট্রিক পয়েন্টের সাথে সংযুক্ত করা যায়। এগুলো বিভিন্ন প্রকারভেদে বিভিন্ন দামের হয়ে থাকে, প্রায় ২০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত একেকটির দাম হয়ে থাকে। তবে কিনলে ভাল মানের এডাপ্টার কেনাই ভাল। খারাপ মানের জিনিসের কারণে অনেক সময় আমাদের ডিভাইসগুলোর ক্ষতি হতে পারে। তাই, একটি ভাল মানের ইউনিভারস্যাল এডাপ্টার বা পাওয়ার কিউব ভ্রমনের সময় অবশ্যই আমাদের সাথে রাখা উচিত।

মাল্টি পারপাস ইউএসবি কেবল
অনেক সময় আমাদের একসাথে অনেকগুলো ডিভাইস একসঙ্গে চার্জ করবার প্রয়োজন হয়। ধরুন যে আপনি ২৪ ঘন্টার বিমান যাত্রা করতে যাচ্ছেন এবং আপনার সিটের সাথে ডিভাইস চার্জ করার জন্য মাত্র একটি ইউএসবি পোর্ট আছে। কিন্তু আপনার একই সাথে আপনার মোবাইল এবং ক্যামেরা চার্জ করতে হবে, তখন এর সমাধান কি? মাল্টি পারপাস চার্জিং কেবলই আপনার সমস্যার সমাধান করতে পারবে। একটি মাল্টি পারপাস ইউএসবি চার্জিং কেবল দিয়ে একসাথে ৩টি ডিভাইস চার্জ করা সম্ভব। এ ধরণের কেবল সাধারণত অন্যান্য কেবলের চেয়ে একটু বেশি লম্বা হয়। যেকোন ধরণের যাত্রাপথে এ ধরণের কেবল খুবই কাজে আসে। সাধারণত এ ধরণের কেবলে একটি লাইটনিং ফাস্ট প্লাগ ( আইফোনের জন্য), একটি ইউএসবি টাইপ সি এবং একটি ইউএসবি ২.০ প্লাগ একই সাথে থাকে। তবে আপনি চাইলে একই ধরণের ৩টি প্লাগ সমন্বিত একটি ইউএসবি কেবল কিনতে পারেন, আপনি কি ধরণের ডিভাইস ব্যবহার করেন তার উপর ভিত্তি করে।

প্ল্যানেটপ্রুফ ক্যামেরা
আমাদের মধ্যে যারা খুবই এডভেঞ্চার প্রেমী এবং যারা সুউচ্চ পাহাড়-পর্বতে আরোহণ করে থাকেন পাশাপাশি স্কাই-ডাইভিং ও আন্ডারওয়াটার সারফিং করে থাকেন, তাদের জন্য এ ধরণের ক্যামেরা হতে পারে একটি আদর্শ ডিভাইস। আপনার চরম এডভেঞ্চারের মুহূর্তগুলোকে ধরে রাখতে আপনাকে ভারী ডিএসএলআর ক্যামেরা ব্যবহার করতে হবে না। এবং আপনি যদি ক্যামেরাটিকে পানির নিচে নিয়ে যেতে চান তবে অন্যান্য একশন ক্যামেরার মত ওয়াটার প্রটেক্টিং কভার ব্যবহার করতে হবে না। ঐ ধরণের ক্যামেরাগুলো প্ল্যানেটপ্রুফ বলে, আপনি কোন ধরণের প্রটেকশন ছাড়াই পানির নিচে এগুলোকে ব্যবহার করতে পারবেন। তাছাড়াও এগুলো ভাল কোয়ালিটি সম্পন্ন ছবি বা ভিডিও ধারণ করতে সক্ষম। তবে একদম প্রফেশনাল লেভেলের ফটোগ্রাফি করা না গেলেও, ভ্লগিং এর কাজও ভালমত করা যাবে এর সাহায্যে। এসকল ক্যামেরার লাইটওয়েটের কারণে, যেকোন দুর্গম স্থানে একে বহন করা সহজ হয়। ছবি বা ভিডিও ধারণ করার সময়, দুর্ঘটনাবশত ক্যামেরাটি আপনার হাত থেকে পরে গেলেও তার একটুও ক্ষতি হবে না। বিভিন্ন নামিদামি ক্যামেরা ব্র্যান্ড এডভেঞ্চার প্রেমীদের জন্যে এ ধরণের ক্যামেরা তৈরি করে থাকে। তবে বর্তমান সময়ে সবচাইতে জনপ্রিয় প্ল্যানেটপ্রুফ ক্যামেরা হল অলিম্পাস ব্র্যান্ডের টাফ টিজি ট্র্যাকার মডেলটি। এছাড়াও অন্যান্য ব্র্যান্ডের বিভিন্ন মডেলের প্ল্যানেটপ্রুফ ক্যামেরা বাজারে নিয়মিত বিক্রয় হচ্ছে।
ফোল্ডেবল ব্যাগ
আমরা যখন দেশের মধ্যে বা দেশের বাহিরে ঘুরতে যাই, তখন সাধারণত সবাই টুকিটাকি শপিং করে থাকি। দিনশেষে যখন বাড়ি ফেরার পালা আসে, তখন দেখা যায় যে আমাদের লাগেজ বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। তখন আমাদের নিকট বাড়তি কোন ব্যাগ বা সুটকেস থাকে না বাড়তি জিনিসপত্র বহন করবার জন্য। নতুন সুটকেস বা ব্যাগ কেনাটাও অনেক সময় ব্যয়বহুল হয়ে যায়। তখন একটি ফোল্ডেবল ব্যাগ বা ব্যাকপ্যাক সাথে থাকলে যাত্রাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। এ ধরণের ব্যাগ বা ব্যাকপ্যাক সাধারণত পলেস্টার কাপড় দ্বারা তৈরি হয়। অনেকগুলো আবার পলি-ইলাস্টিক কাপড় দিয়ে বানানো হয়। যার ফলে ব্যাগগুলো সহজে ফোল্ড করা যায় এবং আমাদের লাগেজের ছোট এক কোণে এঁটে যায়। যখন প্রয়োজন হবে তখন একে আনফোল্ড করে এর ভেতরে অনেক দরকারি জিনিসপত্র ঢুকানো যায়। তবে ভঙ্গুর জিনিসপত্র এর মধ্যে বহন না করাটাই শ্রেয়।

ফোল্ডেবল পানির বোতল
যখন আমরা ভ্রমনে বের হয় তখন সাধারণত বোতলজাত পানি কিনতে আমরা অনেক টাকা নষ্ট করি। ব্যাপারটা টাকা খরচ হচ্ছে তা নয়, এখানে আমরা প্রায়সময়ই নিজেদের অজান্তে পরিবেশের ক্ষতি করে ফেলি। বোতলজাত পানি কিনতে গিয়ে আমরা প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়াচ্ছি এবং সেগুলোকে ঠিক জায়গায় না ফেলে পরিবেশের ক্ষতি করছি প্রতিনিয়তই। তবে আপনি চাইলে একটি ফোল্ডেবল বোতল ব্যবহার করতে পারেন, যার ফলে প্লাস্টিকের ব্যবহার কিছুটা হলেও কমবে। কারণ, একটি পানির বোতল আপনার ব্যাগের অনেকখানি জায়গা নষ্ট করে। পাশাপাশি, বোতলের মুখ ঠিকমত লাগানো না থাকলে জিনিসপত্র ভিজে যাবার সম্ভাবনা থাকে। যদি আপনার নিকট এ ধরণের বোতল থাকে তবে আপনার যখন পানির প্রয়োজন হবে তখন এখানে পানি ভরে সংগ্রহ করতে পারবেন এবং যখন পানি শেষ হয়ে যাবে তখন এ বোতলকে ভাজ করে ব্যাগের কোন কোণায় রেখে দেওয়া যাবে। যদিও সবখানে যে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা থাকবে না কিন্তু নয়। তবে এটি থাকলে আপনার প্লাস্টিকের ব্যবহার অনেক কম হবে এবং যেখানে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা থাকবে সেখান থেকে বিনামূল্যে পানি সংগ্রহ করতে পারবেন। বিদেশ ভ্রমনে গেলে এটি একটি উপকারী বস্তু হয়ে উঠতে পারে।

পোর্টেবল চেয়ার
ভ্রমণে গেলে আমাদের অনেক সময় বিভিন্ন স্থানে অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করতে হয়। বিভিন্ন স্থানে প্রবেশ করতে লম্বা লাইনে অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মাঝে মাঝে আমরা নিজেদের ক্লান্ত অনুভব করতে শুরু করি। তাই এই সমস্যার সমাধান হতে পারে একটি পোর্টেবল চেয়ার। এ ধরণের চেয়ার ফোল্ডেবল ধরনের হয় এবং সহজে ফোল্ড করে প্যান্টের পকেটেও পর্যন্ত ঢুকানো যায়। তাই আপনার লাগেজের ভিতরেও ঢুকাতেও কোন ধরণের বেশি জায়গা নিবে না। তাই সমুদ্রের ধারেই হোক বা পাহাড়ের চূড়ায় হোক, যেখানেই যান না কেন সেখানে যদি বসবার স্থান না থাকে তবে আপনার চেয়ার আনফোল্ড করে বসে পড়তে পারেন এবং বিশ্রাম করে আপনার সময় পার করতে পারেন।

ম্যাসেজিং নেক পিলো
যদি আপনি লম্বা সময় ধরে বাস, ট্রেন বা বিমান যাত্রার উদ্দেশ্যে বের হন তবে একটি ম্যাসেজিং নেক পিলো হতে পারে আপনার জন্য একটি অতি জরুরি জিনিস। এধরণের নেক পিলোতে একটি ব্যাটারি চালিত ভাইব্রেটর সংযুক্ত থাকে এবং এই ভাইব্রেটরটি নেক ম্যাসেজিং এর কাজ করে। লম্বা সময়ের বিমান বা বাস যাত্রায় এটি আপনাকে দিতে পারে এক আরামদায়ক অনুভূতি।

হিটেড জ্যাকেট
যদি আপনি তীব্র শীতপ্রধান অঞ্চলে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হন তবে এ ধরণের জ্যাকেট আপনাকে দিবে প্রয়োজনীয় উষ্ণ অনুভূতি। এ ধরণের জ্যাকেটের ভেতরের বিভিন্ন স্থানে হিটেড চ্যানেল সংযুক্ত থাকে যা একটি ব্যাটারি চালিত সুইচের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এবং এই ধরণের সুইচ বা হাব রিমুভেবল এবং পাওয়ার ব্যাংকের ন্যায় চার্জ করা যায়। ব্যাটারির ধারণক্ষমতা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এ ধরণের জ্যাকেট আপনার শরীরকে উষ্ণ রাখবে এবং তীব্র শীতল আবহাওয়াতেও আপনার চলাচলকে আরামদায়ক করবে। আমাদের দেশের ভ্রমণকারীগণ যখন শীতপ্রধান অঞ্চলগুলোতে ভ্রমণ করতে যান, তখন তাদের অনেকেরই আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে খুবই অসুবিধা হয়। তবে এ ধরণের জ্যাকেট সঙ্গে থাকলে তাদের পথচলা একটু সহজ হতে পারে আরকি। জ্যাকেটগুলো সাধারণত ওয়াটারপ্রুফ হয় এবং এর তাপমাত্রা নিজেদের মত নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

জিপিএস ট্র্যাকার
আমরা অনেক সময় বিভিন্ন জায়গায় আমাদের জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলি নানান রকম তাড়াহুড়ার কারণে। অনেক সময় আমরা আমাদের পাসপোর্টও হারিয়ে ফেলি। এসব জিনিস হারানোতে আমাদের অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। তবে যদি আমাদের নিকট একটি জিপিএস ট্র্যাকার সাথে থাকে, তবে এসকল হারানো জিনিসপত্র আমরা খুঁজে পেতে সক্ষম হতে পারি। তবে জিনিসপত্র খুঁজে পাবার শতভাগ সম্ভাবনা নেই। কারণ অন্য কেউ যদি তা পেয়ে সেখান থেকে জিপিএস ট্র্যাকারটিকে আলাদা করে ফেলে, তবে সেক্ষেত্রে কিছুই করবার থাকে না। তবে এখনকার দিনে অনেক জিপিএস ডিভাইস বের হয়েছে যা দেখতে একটি ছোট কার্ডের মত এবং তা আপনার মুঠোফোনের একটি নির্দিষ্ট এপসের মাধ্যমে কানেক্টেড থাকবে। তাই এধরণের ডিভাইসকে আপনার ওয়ালেট বা পাসপোর্ট কভারের সাথে সহজেই সংযুক্ত করা যেতে পারে। এবং কোন কারণে হারিয়ে গেলে তা সেই মোবাইল এপসের মাধ্যমে ট্র্যাক করে খুঁজে বের করা যেতে পারে।

মিনি ফার্স্ট এইড কিট
এটা অন্যান্য সকল কিটগুলোর চেয়ে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কিট যা ভ্রমণের সময় সকলের সাথে থাকা উচিত। কারণ ভ্রমণের সময় যেকোন ধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। তখন প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য এই ধরনের কিট খুবই কাজে আসে। এ ধরণের মিনি ফার্স্ট এইড কিট দেখতে সাধারণত একটি ছোট বক্সের মত এবং এর ভিতরে অনেক প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দ্রব্যাদি থাকে। তবে আপনি চাইলে ছোট একটা বাক্স কিনে তাতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দ্রব্যাদি মজুদ করে নিজেই একটি মিনি মেডিক্যাল এইড কিট বানাতে পারেন।

আজ তবে এতটুকুই। তবে এ সময়ে যদি কোথাও ভ্রমণে বের হন, তাহলে অবশ্যই বেশি করে ডিস্পোজেবল ফেস মাস্ক এবং ছোট হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল আপনার সঙ্গে রাখুন। সামাজিক দূরত্ব সবসময় বজায় রাখুন। যদিও বিশ্বের কিছু জায়গা এখন নিরাপদ, তবে কোন জায়গাই এখনও এই কোভিড -১৯ ভাইরাসের মহামারির প্রকোপ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়। অনেককেই দেখা যাচ্ছে সাবধানতা অবলম্বন করে ঘুরে বেড়াতে, তবে আপনি এটা করবার আগে ভালভাবে ভেবে নিন। সবাই ভাল থাকবেন ও সুস্থ থাকবেন এবং নিজ নিজ অবস্থানে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখবেন।
Picture Source – //amazon.ca//