আমাদের দেশের যমুনা ফিউচার পার্কের কথাই বলি, শপিং করতে করতে একমাথা থেকে আরেকমাথা পর্যন্ত যেতে আমাদের বাড়োটা বেজে যায়। কি নেই সেখানে, গ্রোসারি শপিং থেকে কম্পিউটার আর মোবাইল ফোন ও এক্সেসরিস, জামাকাপড় থেকে জুতা ও কস্মেটিক্স,জুয়েলারি থেকে হোম এপ্লাইয়েন্সেস আরও কত কি। আছে ফুড কোর্ট, প্লে গ্রাউন্ড, থিম পার্ক, মুভি থিয়েটার এবং মলের সামনে একটি পাঁচ তারকা মানের হোটেলও হচ্ছে। এখানে একই জায়গা থেকে সকল সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে বিধায় লোকজনকে এখানে এসে অনেক ঘুরাঘুরি করতে হয় সঠিক পণ্য বেছে নেবার ক্ষেত্রে। এই ঘুরাঘুরিতেই জান যায় যায় অবস্থা। আমার মনে হয় না কেউই এতদিনে এই মলের এদিক ওদিক মুখস্ত করতে পেরেছেন। যদি যমুনা ফিউচার পার্কের অবস্থা হয় এই, তবে ভেবে দেখুন এর চেয়ে প্রায় ৫ গুন বড় শপিং মলে ঘুরাঘুরি করলে সবার কি অবস্থা হতে পারে !
বিষয়টা অবাক করবার মত, কিন্তু এটা একদমই অবাক করবার মত নয় যে এরকম ৫ গুন বড় শপিং মল দুনিয়াতে অনেক রয়েছে। তার মধ্যে একটা হল কানাডার “ওয়েস্ট এডমন্টন মল” যা উত্তর আমেরিকার সর্ববৃহৎ শপিং মল বলে পরিচিত। কানাডার আলবার্তা প্রদেশের রাজধানী এডমন্টন শহরের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় অবস্থিত এই শপিং মল প্রায় ৫৩ লাখ স্কয়ার ফিট স্থান জুড়ে আছে। যা প্রায় ৯০ টি ফুটবল মাঠের সমান। ১৯৫৯ সালে এর গোড়াপত্তন হয় দুই ইরানি ব্যবসায়ীর মাধ্যমে। পরবর্তীতে ইহা বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের আওতায় আসে এবং ধীরে ধীরে এর আকার বড় হয়। এটি ২০০৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সর্ববৃহৎ শপিং মল বলে পরিচিত ছিল।
ওয়েস্ট এডমন্টন মলের ভিতরে বাহিরে।
এখানে প্রায় ৮০০ টিরও বেশি দোকান ও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের আউটলেট রয়েছে। পরিচিত ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে এপেল স্টোর, স্যামসাং, মাইক্রোসফট, নর্থ ফেস, কানাডা গুস, কোলাম্বিয়া ইত্যাদি ব্র্যান্ডের অফিসিয়াল আউটলেট এখানে রয়েছে। পাশাপাশি এখানে বিভিন্ন কনভেনিয়েন্ট স্টোরও আছে যেখানে আপনি রেগুলার শপিং করতে পারেন। এদের মধ্যে ডলারামা, ডলার স্টোর, ওয়েস্ট ওয়ে, সেফওয়ে ইত্যাদি অন্যতম। এছাড়া ইউনিক্লো ও মিনিসোর মত জাপানি ব্র্যান্ডগুলোর আউটলেটও এখানে আছে, যাদের বাংলাদেশের বিভিন্ন শপিং মলে আউটলেট রয়েছে। এখানে রয়েছে অনেক বিশাল এক ফুডকোর্ট যেখানে কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডস, এ&ডাব্লিউ আরও নানা ব্র্যান্ডের ফুডচেইন শপগুলো রয়েছে। বাংলাদেশি কোন খাবারের দোকান না থাকলেও এখানে বিভিন্ন ইন্ডিয়ান এবং চায়নিজ রেস্টুরেন্ট রয়েছে। রয়েছে কিছু সংখ্যক হালাল রেস্টুরেন্টও। নেটিভ ও বিদেশী পশ্চিমাদের জন্য রয়েছে এখানে অনেকগুলো বার যা একটি আলাদা জোনে অবস্থিত। একে বোরবন স্ট্রিট বলা হয়ে থাকে।
ওয়েস্ট এডমন্টন মলের কিছু উল্লেখযোগ্য শোরুম।
ফুডকোর্ট।
ড্রিংকিং জোন।
আনন্দ ও বিনোদনের আয়োজনেরও এখানে অভাব নেই। এখানে রয়েছে একটি থিম পার্ক যা গ্যালাক্সিল্যান্ড নামে পরিচিত, রয়েছে মুভি থিয়েটার, আইস স্কেটিং গ্রাউন্ড, ওয়াটার পার্ক যা ইন্ডোর বিচ নামে পরিচিত। গ্যালাক্সিল্যান্ডে রয়েছে কিছু রোমাঞ্চকর রাইডস যা হয়তো আপনি আগে কখনও উপভোগ করেননি। আইস স্কেটিং গ্রাউন্ডে সাধারণত বাচ্চাদের স্কেটিং শেখানো হয়। এখানে বাচ্চাদের আইস হকি লিগের ম্যাচও সবসময় অনুষ্ঠিত হয়। আবার কখনও দেখেছি বিভিন্ন সিনিয়র দলকে আইস হকি অনুশীলন করতে। ইন্ডোর বিচ যেটা সেটা এত আহামরি কিছু নয়। ঐ আমাদের দেশের ফ্যান্টাসি কিংডমের ওয়েভ পুলের মত যার আকার কিছুটা বড়। আর এর আশেপাশে কিছু বার আর রেস্টুরেন্ট রয়েছে আরকি। বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য আরও রয়েছে ইন্ডোর ট্রেন ও ফান রাইড। ইন্ডোর ট্রেনে বাচ্চাদের শপিং মলের পুরো চক্কর দেওয়া হয়।ফান রাইডে বাচ্চারা নিজেরা নিজেদের মত রাইড চালিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বাচ্চাদের জন্য এখানে আলাদা গলফ কোর্সও রয়েছে।
গ্যালাক্সিল্যান্ডের ভেতর বাহির।
ইন্ডোর বিচ।
আইস-স্কেটিং ও আইস-হকি গ্রাউন্ড।
বাচ্চাদের জন্য ফানরাইড ইন্ডোর ট্রেন।
বাচ্চাদের গলফ কোর্স।
এ শপিং মলের একটা ভাল দিক হল যে, অনেক বড় মল হওয়া সত্ত্বেও আপনাকে কোন স্টোর বা আউটলেট খুঁজতে হলে কাউকে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করতে হবে না। যদিও জিজ্ঞাসা করা দোষের কিছু নয় এবং কানাডিয়ানরা যথেষ্ট হেল্পফুল। এখানে বিভিন্ন পয়েন্টে বড় বড় টাচ স্ক্রীন মনিটর রয়েছে যেখান থেকে আপনি সহজেই পথ নির্দেশনা পাবেন। তাছাড়াও আপনি আপনার ফোনে মলের অফিসিয়াল এপ নামিয়ে সেখান থেকে বিভিন্ন তথ্য ও নির্দেশনা পেতে পারেন। মলের এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে যদি ক্লান্ত হয়ে যান তবে, বিভিন্ন জায়গায় আগত অতিথিদের জন্য বসবার স্থানও রয়েছে। সেখানে রয়েছে মোবাইল ও ল্যাপটপ চারজিং এর পয়েন্ট। পুরো শপিং মলের ভিতরে আপনি ফ্রি ওয়াই-ফাই ব্যবহারের সুযোগ পাবেন।
মলের ভেতরে ন্যাভিগেশন স্ক্রীন যার মাধ্যমে পথ-নির্দেশনা পাওয়া যায়।
আগত অতিথিদের বসবার স্থান।
এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হল এর ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন। সম্পূর্ণ মলের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন খুবই চমৎকার। বিভিন্নখানে রয়েছে পানির ফোয়ারা। এখানে আরও আছে একটি বড় ওপেন স্টেজ যেখানে বিভিন্ন কালচারাল প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। রয়েছে একটি ইন্ডোর পুল যেখানে সীলায়নদের (শীল মাছ) কারসাজি নিয়ে বিভিন্ন শো দেখানো হয়। পুলের সামনের সারিতে বসে শো দেখতে হলে আপনাকে পয়সা খরচ করতে হবে। কিন্তু দোতালায় রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে থেকেও আপনি এ শো ভালভাবে উপভোগ করতে পারেন। এই ইন্ডোর পুলটিকে নানাভাবে সজ্জিত করা হয়েছে। শপিং মলের বিভিন্ন জায়গায় আপনি নানারকম ভাস্কর্যের দেখা পাবেন। যার কোনটা অর্থবহ আর কোনটা নয়। এখানে বিভিন্ন সময়ে নিয়মিত লটারি র্যাফেল ড্র অনুষ্ঠিত হয়। আপনার ভাগ্য ভাল থাকলে পেয়ে যেতে পারেন ফেরারি ব্রান্ডের একটি লেটেস্ট মডেলের গাড়ি। এর জন্য আপনাকে লটারির টিকিট ক্রয় করতে হবে। প্রতি বছরে একবার এই লটারির ড্র অনুষ্ঠিত হয়।
শপিং মলের ইন্টেরিয়রের কিছু দৃশ্য।
ইন্ডোর পুলের উপর সাজ-সজ্জা।
সীলায়ন শো এর কিছু চিত্র।
এরকম আরো ভাস্কর্যের সমাহার দেখতে পাবেন এখানে।
ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে লটারিতে পেয়ে যেতে পারেন একটি ফেরারি ব্রান্ডের গাড়ি।
মলের বাহিরে আশেপাশেও অনেকগুলো কনভেনিয়েন্ট স্টোর, গাড়ির শোরুম, লিকুইর স্টোর, পন শপ ও কিছু ফুয়েল স্টেশন আছে। যা পুরো ১৭০ স্ট্রিট এলাকাকে একটি শপিং জোনে গড়ে তুলেছে। এখানে প্রায় ৮০০০০ গাড়ি পারকিং এর ব্যবস্থা আছে। এডমন্টন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে খুবই স্বল্প দূরত্বে এর অবস্থান। আপনি যদি এডমন্টন শহরের যেখানেই অবস্থান করুন না কেন, বাস স্টপেজ থেকে ২ বা ১১১ নম্বর বাসে উঠে পড়ুন। এবং বাস আপনাকে সঠিক গন্তব্যে পৌছে দেবে। এই শপিং মল হল এই শহরের কেন্দ্রবিন্দু। শহরের মানুষদের আনন্দ বিনোদনের প্রধান প্রাণকেন্দ্র। কারণ কানাডাতে সামার ছাড়া অন্য কোন সময়ে বাহিরে বেশি ঘুরাঘুরি করা যায় না। আর এডমন্টন শহরে সামার থাকে মাত্র ৩মাসের মত। বাকি সময় থাকে তীব্র ঠান্ডা, সেলসিয়াসে তাপমাত্রা প্রায় অধিকাংশ সময়ে হিমাংকের নিচে থাকে। এর এখানকার ঠান্ডার সাথে বাংলাদেশের ঠাণ্ডা তুলনা করা যায় না। এমনকি ভারতের সিকিম, দারজিলিং, সিমলা বা নেপাল কিংবা ভুটানের ঠান্ডা আবহাওয়া কানাডার ঠান্ডা আবহাওয়ার কাছে অতি নগন্য। তাই এখানকার মানুষ ইন্ডোর এক্টিভিটির দিকেই বেশি আগ্রহী। তাই এডমন্টন শহরে সপ্তাহশেষে শহরবাসী এখানে এসে ভিড় জমান।
আজ তাহলে এতটুকুই। আবার কথা হবে অন্যান্য কোন স্থাপনা, ভ্রমণস্থান, ভ্রমণকাহিনী কিংবা ভ্রমণ বিষয়ক অন্যান্য কিছু নিয়ে। তবে যেখানেই ভ্রমণ করুন না কেন সবসময় খেয়াল রাখবেন আপনার জন্য পরিবেশ যাতে নোংরা না হয়। পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে আমাদের সর্বদা সচেতন থাকা উচিত। আর বিদেশ ভ্রমণে গেলে এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে, বাংলাদেশীদের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়।
So, travel more & be happy. Always remember that your mobility is your freedom.
ছবিসূত্রঃ নিজস্ব ধারণকৃত।