এশিয়া মহাদেশে সবচাইতে বেশি মুসলিমদের বসবাস এবং ইসলাম ধর্মের অনুসারীগণ এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস্থানে আছে। বর্তমান পরিসংখ্যান অনুযায়ী এশিয়াতে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ১.১ বিলিয়ন। সৌদি আরবের মক্কা শরীফ মুসলমানদের প্রধান তীর্থস্থান এবং এখান থেকেই মূলত এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ইসলাম ধর্মের প্রচার হয়েছে। এশিয়ার আরব অঞ্চলগুলোর পাশাপাশি মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটেছে। যার জন্যে নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও ইসলামিক সেন্টার ইত্যাদি। এগুলোর কিছু নির্মিত হয়েছে অনেক প্রাচীন আমলে এবং কিছু নির্মিত হয়েছে বর্তমান শতাব্দীতে। ধর্মীয়ভাবে সকল মসজিদগুলো মুসলমানদের নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু কিছু কিছু মসজিদের নির্মাণকাজ ও এদের নির্মাণকৌশলী সবাইকে আলাদাভাবে মুগ্ধ করে। সেসকল মসজিদগুলো তাদের নির্মাণকাজ, নির্মাণকৌশলী এবং চারপাশের পরিবেশের জন্য পর্যটকদের কাছে বিখ্যাত। যেখানে পর্যটকদের পাশাপাশি দেখা মিলবে ইতিহাস প্রেমীদের। তাই আজ কথা হবে, এশিয়াতে নির্মিত সুদর্শনীয় ৭টি মসজিদের ইতিবৃত্তান্ত সম্পর্কে। এর অধিকাংশ স্থাপনাগুলোই নির্মিত হয়েছে বর্তমান সময়ে বা শতাব্দীতে।
শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ, আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাত
সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবীতে নির্মিত শেখ জায়েদ গ্র্যান্ড মসজিদ দেখতে পর্যটকদের ভীড় সহসাই আপনার চোখে পড়বে। সুদর্শনীয় এই মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে আরব আমিরাত এর প্রয়াত রাষ্ট্র প্রধান শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাইয়ানের নামানুসারে। মসজিদটি এদেশের সবচেয়ে বড় মসজিদ। এমনকি এ মসজিদ পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম ও সুন্দরতম। ১৯৯৬ সাল থেকে নির্মাণ কাজ শুরু করে ২০০৭ সালে মসজিদ উদ্বোধন করা হয় । মসজিদ নির্মাণে প্রায় ৫৪৫ মিলিয়ন ইউ এস ডলার খরচ হয়েছে বলে জানা যায়। সিরিয়ার আর্কিটেক্ট ইউসুফ আব্দালকি এটি ডিজাইন করেন। বিশ্বের ৩৮ টি প্রখ্যাত ঠিকাদারি কোম্পানির ৩০০০ হাজার দক্ষকর্মীদের হাতে স্থাপিত হয়েছে এই মসজিদটি। অত্যন্ত আধুনিক নির্মাণশৈলী এবং ব্যবস্থাপনা যেকোনো পর্যটককে আকৃষ্ট করবে। এখানে প্রায় ৪০,০০০ মানুষ নামাজ পড়তে পারেন। এই মসজিদটি কয়েকটি হলে বিভক্ত। প্রধান হলের ধারণ ক্ষমতা ৭০০০। সাথেই রয়েছে ২টি প্রার্থনা হল এক একটি ১৫০০ ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন। যার ১ টি মহিলাদের জন্য। প্রতিটির সঙ্গে দুটি ছোট প্রার্থনা হলও আছে। এই মসজিদ নির্মাণে মার্বেল পাথরের আধিক্য বিদ্যমান। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ আয়তনের মার্বেল মোজাইক এখানে নির্মিত হয়েছে। এছাড়াও এখানে সোনা, আধা মূল্যবান পাথর, স্ফটিক ও মৃৎশিল্পের বিভিন্ন উপকরন ব্যবহার করা হয়েছে। সম্পূর্ণ মসজিদের ডিজাইন ও নির্মাণে ইতালি, জার্মানি, মরক্কো, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইরান, চীন, যুক্তরাজ্য, নিউজিল্যান্ড, গ্রিস ও সংযুক্ত আরব সহ অনেক দেশ থেকে উপকরণ সংগ্রহ ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদটিতে আছে ছোট-বড় সাত আকারের ৮২টি গম্বুজ। যা নির্মাণ করা হয়েছে স্বেত মার্বেল দিয়ে। মসজিদের বৃহত্তম গম্বুজের উচ্চতা ২৭৯ ফুট। মসজিদ ভবনের চারকোণে ৪টি সুউচ্চ মিনার বিদ্যমান যার এক একটির উচ্চতা প্রায় ১০৭ মিটার করে। এর ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনে ব্যবহার করা হয়েছে অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন ঝাড়বাতি। সমগ্র বিশ্বের পর্যটকদের কাছেও এই মসজিদ অন্যতম জনপ্রিয় একটি জায়গা। আবুধাবি শহর থেকে মাত্র ১৫ মিনিটের দুরত্বে এই মসজিদের অবস্থান। দুবাই থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১ ঘন্টা ১০ মিনিটের মত।
শেখ জায়েদ মসজিদের ভেতর বাহিরের কিছু দৃশ্য।
সুলতান ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদ, বান্দার সেরি বেগওয়ান, ব্রুনাই
রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলামের প্রতীক হিসেবেই ব্রুনেইয়ের রাজধানী বান্দার সেরি বেগওয়ানে ১৯৫৮ সালে গড়ে তোলা হয় দৃষ্টিনন্দন সুলতান ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদ। কৃত্রিম একটি জলাধারে গড়ে তোলা এই মসজিদের একটি আকর্ষণীয় দিক হলো জলাধারে ১৬ শতকের সুলতান বলখিয়ার সময়কার একটি রণতরীর রেপ্লিকা। আর মসজিদটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো খাঁটি স্বর্ণে তৈরি এর প্রধান গম্বুজটি। আসলে মসজিদটির প্রধান গম্বুজটির বাইরের অংশ সম্পূর্ন খাঁটি সোনা দিয়ে মোড়ানো। এছাড়াও প্রতিটি ছোট ছোট মিনারের উপরের গম্বুজ সদৃশ অংশগুলোও স্বর্ণ দ্বারা আচ্ছাদিত করা হয়েছে। মসজিদটি ৫২ মিটার (১৭১ ফুট) উচ্চতায় নির্মিত বলে শহরের যেকোন প্রান্ত থেকে সহজেই দেখা যায়। আবার মসজিদের প্রধান মিনারে উঠলে পুরো বন্দর সেরি বেগাওয়ান শহরের ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পাওয়া যায়। মসজিদটির প্রবেশের জন্য সুদীর্ঘ একটা ব্রীজ রয়েছে। উঁচু মিনারটিতে রয়েছে একটি আধুনিক এলিভেটর। যার মাধ্যমে স্থাপনার শীর্ষে উঠা যায় সহজেই। পুরো মসজিদ কমপ্লেক্স ঘিরে আছে মনোরম বাগান ও ফোয়ারা। পবিত্র কুরআন নাজিল হবার ১,৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে নির্মিত এই মসজিদটির নির্মাণ খরচ প্রায় ৯.২ মিলিয়ন ডলার বলে জানা যায়। ৫ একর জমির উপর নির্মিত মসজিদটির ভেতরের অংশে একসাথে ৩০০০ মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারেন। ব্রুনাইয়ের জনক সুলতান ওমর আলী সাইফুদ্দিন ক্ষমতায় আসার পর শহরে একটি মসজিদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে লাগলেন। তাছাড়া দেশে ইসলামিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে রাজধানী শহরে একটি অভিজাত মসজিদ নির্মাণ করা দরকার ছিল । সুলতান তাই বন্দর সারি বেগাওয়েনকে দেশের ইসলামিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে বিশাল এক ব্যয়বহুল প্রকল্প হাতে নেন। তাই ১৯৫৪ সালে মসজিদের কাজ শুরু হয় এবং ১৯৫৮ সালে মসজিদের উদ্বোধন করা হয়। মসজিদের ডিজাইন করেন ইতালিয়ান স্থপতি ক্যাভালিয়ের রুডলফ নোলি। মসজিদটি নির্মানে অত্যন্ত দামী গ্রানাইট, মার্বেল ব্যবহার করা হয়। ইতালি থেকে আনা হয় মার্বেল পাথর, গ্রানাইট আনা হয় চীন থেকে, আর ইংল্যান্ড থেকে আনা হয় মসজিদের ভেতরের সাজসজ্জার জন্য ঝাড়বাতি। মসজিদের বিশালাকায় দরজাগুলো তৈরি করা হয়েছিল ফিলিপাইন থেকে আমদানি করা উৎকৃষ্ট কাঠ দিয়ে। নির্মাণ শেষে মসজিদটি হয়ে ওঠে গোটা দেশের প্রতিচ্ছবি। আর এর নামকরণ হয় সুলতানের নামে। মসজিদটি রবি থেকে বুধবার পর্যন্ত সপ্তাহে চারদিন দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। ব্রুনাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে মসজিদটির অবস্থান।
এক নজরে সুলতান ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদ।
ক্রিস্টাল মসজিদ, কুয়ালা তেরেংগানু, মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়ার তেরেংগানু প্রদেশের সবচেয়ে বড় শহর কুয়ালা তেরেংগানুতে অবস্থিত এই অন্যরকম স্থাপনার দৃষ্টিনন্দন মসজিদটি। একে অন্যরকম বলার কারণ হল যে, অন্যান্য মসজিদসমূহের গম্বুজ বা মিনার সুসজ্জিত করতে সাধারণত গ্রানাইট, মার্বেল পাথর ব্যবহার ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় এমনকি স্বর্ণের ব্যবহারও দেখা গেছে ব্রুনাই এর সুলতান ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদে। কিন্তু এখানে ব্যবহার করা হয়েছে ক্রিস্টাল গ্লাস, গম্বুজ ও মিনার সজ্জিত করার জন্য। যার জন্য এর নামকরণ করা হয়েছে ক্রিস্টাল মসজিদ। এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০০৬ সালে যা শেষ হয় ২০০৮ সাল নাগাদ। গম্বুজ ও মিনার ক্রিস্টাল গ্লাস দ্বারা সজ্জিত করার ফলে দিনের বেলা এগুলোতে সূর্যের আলোর ঝলকানির খেলা দেখা যায় যা দূর হতে দেখতে মনোমুগ্ধকর। যেজন্য এ মসজিদের মিনার ও গম্বুজগুলোকে দিনের একেক সময়ে একেক রকম দেখায়। এখানে মূল গম্বুজসহ প্রায় ১০ টি গম্বুজ, ৪টি সুউচ্চ মিনার ও ৪টি ছোট মিনার রয়েছে যার প্রতিটি ক্রিস্টাল গ্লাস দ্বারা মোড়ানো। রাতের বেলা গম্বুজ ও মিনারগুলোতে লাইট ডিসপ্লে প্রদর্শন করা হয়। এই মসজিদের ধারণক্ষমতা প্রায় ১৫০০ জনের মত। এর ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং এ মার্বেল পাথরের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। মূল গম্বুজ হতে তিন তলা নিচে একটি দৃষ্টিনন্দন ঝাড়বাতি স্থাপন করা হয়েছে। মসজিদের ভেতরে নানা রকম আধুনিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে। যার মধ্যে ওয়াইফাই সংযোগ অন্যতম যা ডিজিটাল কুরআন পড়তে এবং ইসলামিক গবেষণায় ব্যবহার হয়। এমন অন্যরকম স্থাপনার জন্যে মসজিদটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছে এবং সারা বিশ্বের দর্শনার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। মসজিদটি কুয়ালা তেরেংগানুর সুলতান মাহমুদ বিমানবন্দর থেকে প্রায় ১৩ কিলমিটার দূরে।
ক্রিস্টাল মসজিদের ভেতর বাহির।
ফয়সাল মসজিদ, ইসলামাবাদ, পাকিস্তান
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অবস্থিত এই মসজিদটি ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি পাকিস্তানের বৃহত্তম মসজিদ, যা ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত মসজিদটি পৃথিবীর বৃহত্তম মসজিদ ছিলো। এই মসজিদের নির্মাণ কাঠামো অন্যান্য মসজিদের চাইতে আলাদা। দেখতে অনেকটা আরবের বেদুইনদের তাবুর মত। আরবীয় বেদুইনেরা যেমন চারপাশে ৪টি খুটি গেড়ে তাঁবু টানাতো তেমনি এই মসজিদের ৪টি সুউচ্চ মিনার খুতির ন্যায় দেখাচ্ছে এবং মূল ভবনকে টাঙানো তাঁবুর মত দেখাচ্ছে। তুর্কি স্থপতি ভেদাত ডালোকে এর দৃষ্টিনন্দন ডিজাইন করেন। সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশা ফয়সাল বিন আব্দুল আজিজ এর আর্থিক সহায়তায় ১৯৭৬ সালে নির্মাণ শুরু হয় এ মসজিদের। পরবর্তীতে এই মসজিদটি বাদশাহ্ ফয়সালের নামে নামকরণ করা হয়। এর নির্মাণখরচ হয় ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। গম্বুজবিহীন এ মসজিদের আটটি ঢালু ছাদ রয়েছে। মসজিদের দেয়াল থেকে শুরু করে ছাদ পর্যন্ত সূর্যের আলো প্রবেশের বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনও চমৎকারভাবে করা হয়েছে। ভবনের মূল অংশের ভিতরে ঠিক মাঝখানে একটি দৃষ্টিনন্দন ঝাড়বাতি স্থাপন করা হয়েছে যা দেখতে একদম একটা গোলকের মত।মসজিদের মিহরাবের ডিজাইন করা হয়েছে একটি খোলা পবিত্র কুরআন কিতাবের ন্যায়। ভবনের মেঝ লাল কার্পেট দ্বারা মোড়ানো। মসজিদের তিন দিকে সবজু বনবেষ্টিত পাহাড় শ্রেণী এবং মূল ভবনের চার দিকে বিশাল খোলা চত্বর সবুজ বেষ্টনী দ্বারা আবৃত। মসজিদটি মারগালা পাহাড়ের ঢালু পাদদেশে অবস্থিত হওয়ায় একে ইসলামাবাদ শহরের যেকোন প্রান্ত হতে দৃশ্যমান হয়। এর মিনারগুলোর উচ্চতা ২৬০ ফুট করে। মসজিদটির ধারণক্ষমতা প্রায় ২ লাখ ৭৪ হাজার। দক্ষিণ এশিয়ার এই সর্ববৃহৎ মসজিদটি ইসলামাবাদ শহরের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়।
ফয়সাল মসজিদ, ইসলামাবাদ।
সুলতান মসজিদ, সিঙ্গাপুর
৭২১ বর্গকিলোমিটারের ছোট দেশ সিঙ্গাপুরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ।মসজিদটি নির্মাণলগ্ন থেকে আজ অবধি অপরিবর্তিত অবস্থাতেই রয়েছে। অর্থাৎ যেমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছিল,ডিজাইনে আর কোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়নি।মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৮২৪ সালে এবং শেষ হয় ১৮২৬ সালে। সুলতান হোসাইন শাহ্ এই মসজিদটি নির্মাণ করেন। সিঙ্গাপুরে ধর্মীয় লোক সংখ্যার অনুপাতে মুসলিম খুব বেশি নয়, মাত্র ১৫ %। যদিও এদেশে ধর্ম নিয়ে কারোও ততটা মাথা ব্যাথা নেই বা বলা চলে ধর্মীয় গোড়ামিমুক্ত । সিঙ্গাপুরিয়ানদের প্রায় সব মালয় এবং ২৫% ইন্ডিয়ান মুসলিম ধর্মানুসারী। তাই এই মসজিদকে কেন্দ্র করে এর আশেপাশে গড়ে ওঠেছে সিংগাপুরের মুসলমান এলাকাগুলো। চারপাশে স্ট্রিট গুলোর নাম মাসকাট স্ট্রিট, বাগদাদ স্ট্রিট, হাজি লেন, আরব স্ট্রিট, ইত্যাদি। প্রতিটি লেন এ আরবীয় খাবার দোকান,লেবানন, তুর্কি, ইরান, ইরাকের এর ঐতিহ্যবাহি কার্পেট,বোরকা, হিজাব, জায়নামাজ ইত্যাদি পাওয়া যায়। মসজিদটির কাঠামোতে মৌলিক কোন পরিবর্তন না করা হলেও এর নির্মাণের ১০০ বছর পর অর্থাৎ ১৯২৪ সালে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করে মসজিদের সংস্কার কাজ করা হয়। মসজিদটিকে বাহির থেকে দেখলে একটি রাজপ্রাসাদ মনে হবে। এর মূল গবুজটি দেখতে অনেকটা ব্রুনাই এর সুলতান ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদের গম্বুজের মত। কিন্তু ইহা স্বর্ণমোন্ডিত নয়। এর মসজিদের মিহরাবের ন্যায় মূল ফটক সবাইকে স্বাগত জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছে। এবং মূল ভবনের সামনে সারি সারি লম্বা খেজুর গাছ মিনারের মত দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদের ভেতরের ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং এ বিভিন্ন আরবিক ক্যালিয়গ্রাফি ও নকশা রয়েছে। এর ভেতরে প্রতিটি ফ্লোরে সারি সারি দৃষ্টিনন্দন ঝাড়বাতি রয়েছে। মসজিদের এক কোণে রয়েছে একটি ডিজিটাল মিউজিয়াম। এখানে কয়েকটি বড় টাচস্ক্রীন মনিটর আছে যেখানে এই মসজিদ সংক্রান্ত নানা তথ্য ও বিভিন্ন ইসলামিক বই সংরক্ষণ করা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য। এখানে মহিলাদের জন্য আলাদাভাবে নামাজের সুব্যবস্থা রয়েছে। এখানে প্রায় ৫০০০ জন লোক একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের বাহিরে অনেকগুলো বিপণিবিতান রয়েছে যেখানে দর্শনার্থীদের ভিড় সবসময় থাকে। মসজিদটি কাম্পং গ্ল্যাম অঞ্চলে অবস্থিত যেখানে সিঙ্গাপুরের যেকোন এমআরটি স্টেশন থেকে সহজে যাওয়া যায়।
সুলতান মসজিদ, সিঙ্গাপুর।
ডিজিটাল মিউজিয়াম।
ভেতর-বাহির।
হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর মসজিদ, দোহা, কাতার
কাতারের রাজধানী দোহায় অবস্থিত হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বিশ্বের সুন্দর ও আধুনিক বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাই বিমানবন্দরের যাত্রীদের নামাজের সুবিধার জন্য এখানে গড়ে তোলা হয়েছে একটি দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। এই মসজিদের গঠনশৈলী একদমই আলাদা। বৃত্তাকার আকৃতির এই মসজিদটির ছাদের সম্পূর্ণ অংশই বিশাল আকৃতির একটি কাঁচের গম্বুজ দ্বারা বেষ্টিত। তাই মসজিদটিকে দূর থেকে দেখলে বড় একটি হীরের টুকরা মনে হবে। মূল ভবনের পাশে একটি মিনার আছে যা খুব বেশি লম্বা নয়। মূল ভবনের সামনে অনেকগুলো পানির ফোয়ারা রয়েছে। রাতের বেলা এই মসজিদটির আলোকসজ্জা বিমানবন্দরের সকল যাত্রীদের দৃষ্টি কাড়ে। মসজিদের ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং এর বাহ্যিক অংশের মতই নজরকাড়া। এখানে অনেক আরবিক ক্যালিয়গ্রাফি দ্বারা সাজানো হয়েছে এর ভেতরের অংশ। মসজিদের সর্বাধিক বিশিষ্ট অংশটি পুরো ছাদটি গম্বুজ আকারের রয়েছে যা এর মূল আকর্ষণ। বিশ্বের বেশিরভাগ মসজিদের গম্বুজ রয়েছে তবে সেগুলি কেন্দ্র বা নির্দিষ্ট স্থানে রয়েছে তবে পুরোটা নয়। পুরো গম্বুজটি কাঁচের তৈরি ও এর ভেতরের প্যাটার্নে ফুলের মত নকশা করা হয়েছে। গম্বুজটিতে রাতে আলো জ্বালানো থাকে এবং ভেতরের বাতিগুলিকে উপরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দিনের আলো রোদের মাধ্যমে হয় যা কাচের ছাদ থেকে মসজিদের অভ্যন্তরে আসে। হামাদ বিমানবন্দরের বহির্গমন যাত্রীগণ এখানে সহজে যেতে পারেন। আগত যাত্রীদের ইমিগ্রেশন পার হয়েই তবে যেতে হয়।
এক নজরে দোহা বিমানবন্দর মসজিদ।
মাশখুর জুসুপ মসজিদ, পাভ্লোদার, কাজাখস্থান
মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্থানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর পাভ্লোদারে এই মসজিদটির অবস্থান। এটি ২০০১ সালে নির্মাণের এক বছর পরে খোলা হয়েছিল এবং এখানে প্রায় ১৫০০ জন একত্রে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছিল কাজাখ কবি ও ইতিহাসবিদ মাশখুর জুসুপ এর নামানুসারে। এই মসজিদটির মূল ভবনের আকার দূর হতে দেখলে কিছুটা পিরামিডের মত দেখতে। কিন্তু আসলে তা একদমই নয়। এর নির্মাণকৌশলী সম্পূর্ণ আলাদা। ভবনটির ভিত্তি আটটি পয়েন্টের সাথে অষ্টভুজাকার তারকা আকারে নির্মিত যার ব্যাস ৪৮/৪৮ মিটার। মসজিদ ৪টি মিসাইল আকৃতির মিনারগুলির একেকটির উচ্চতা ৬৩ মিটার এবং এর প্রতীকী উচ্চতা ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর বয়সের সাথে মিলে যায়। এর একমাত্র আকাশী-নীল গম্বুজটির উচ্চতা ৫৪ মিটার যা অষ্টভুজাকার তারকা আকারে নির্মিত ভবনের আটটি মূল স্তম্ভের উপর বসানো হয়েছে। মূল ভবনের সামনে একটি ত্রিভুজাকৃতির একটি বড় ফটক রয়েছে। এই মসজিদে নামাজের ঘরের পাশাপাশি একটি স্কুল, বিয়ের হল, গ্রন্থাগার, ডাইনিং রুম এবং একটি ইসলামী সংস্কৃতি জাদুঘর রয়েছে। প্রাথমিকভাবে মনোলিথিক লোহার কংক্রিট, ইট, ধাতু, মার্বেল এবং অ্যালুমিনিয়াম গঠন করে এটির স্থাপত্যটি একটি অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে এবং দেশের অনেক নগর নকশাকে প্রভাবিত করে। অবশ্যই এর কেন্দ্রের অংশটি অনন্য এবং বিশ্বের অন্য কোথাও এটি দেখতে পাওয়া যায় না। এর অভ্যন্তরে একটি স্ফটিক ঝাড়বাতি যা “জুমরাদ” নামে পরিচিত স্থাপন করা হয়েছে যাতে ৪৩৪ টি প্রদীপ রয়েছে এবং এটি মসজিদের অভ্যন্তরকে সুশোভিত করে, এটি উজবেকিস্থানের তাশখন্দে তৈরি হয়েছিল। মসজিদটির স্থাপত্যটি একটি উন্মুক্ত হৃদয়ের সাদৃশ্য হিসেবে তৈরি করা হয়েছে যা বিশ্বের সকলের আকর্ষণ কেড়ে নিতে সক্ষম।
মাশখুর জুসুপ মসজিদ।
আজ তাহলে এতটুকুই। আবার কথা হবে অন্যান্য কোন স্থাপনা, ভ্রমণস্থান, ভ্রমণকাহিনী কিংবা ভ্রমণ বিষয়ক অন্যান্য কিছু নিয়ে। তবে যেখানেই ভ্রমণ করুন না কেন সবসময় খেয়াল রাখবেন আপনার জন্য পরিবেশ যাতে নোংরা না হয়। পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে আমাদের সর্বদা সচেতন থাকা উচিত।
So, travel more & be happy. Always remember that your mobility is your freedom.
Picture Source – Collected Pictures.